প্রাকৃতিক উপায়ে চুলের যত্ন নেওয়ার কিছু ঘরোয়া টিপস

আমরা ত্বক নিয়ে যেভাবে চিন্তিত ঠিক একইভাবে চুল নিয়েও চিন্তিত থাকি। ত্বক নিয়ে যেমন আমাদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় তেমনি চুল নিয়েও অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। দেখতে সুন্দর হলেও যদি চুল সুন্দর না হয় তাহলে মনটাই যেন নষ্ট হয়ে যায়। চুল পড়া, চুল ভেঙে যাওয়া, চুল ঠিকমতো বৃদ্ধি না পাওয়াসহ নানা সমস্যায় পড়তে হয় আমাদের। আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা উঠে পরে লাগি চুলের জন্য নানা জাতীয় প্রসাধনী পণ্য কিনতে। যার কিছু সাইড এফেক্টও রয়েছে। এসব প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে অনেক সময় সমস্যার সমাধান হওয়ার বদলে সমস্যার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর তাই আমি আজ আপনাদের সামনে চুলের যত্নে প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি কিছু ঘরোয়া প্যাক এবং কিছু টিপস নিয়ে হাজির হয়েছি। এটি যেমন নিরাপদ তেমন কার্যকরি।
আসুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক সেই কী কী –
প্রাকৃতিক উপায়ে চুলের যত্নে কিছু ঘরোয়া সমাধান:
চুল পড়া কমানোর জন্য কী করবেন :
উপাদান-
- ডিম
- পেঁয়াজ
- অলিভ অয়েল
পদ্ধতি-
১. প্রথমে চুলকে ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিন।
২. এরপর একটা অথবা দুটো ডিমের সাদা অংশ আলাদা করে এর মধ্যে ১-২চা চামচ অলিভ অয়েল এবং ১-২টা পেঁয়াজ বেটে পেঁয়াজের রস ছেঁকে নিয়ে একসাথে মিশিয়ে চুলে লাগিয়ে নিন।
৩. এবার চুল শুকানোর জন্য অপেক্ষা করুন। শুকিয়ে গেলে আপনার ব্যবহার করা শ্যাম্পু দিয়ে ভালো করে চুল ধুয়ে নিন।
এভাবে ১৫দিনে একবার করে ব্যবহার করলেই আশানুরুপ ফল অবশ্যই পাবেন। ডিম চুল পড়া কমিয়ে চুলকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলে। ডিমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে যা নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। এছাড়াও একটি সেদ্ধ ডিম প্রতিদিন খাবারের তালিকায় রাখুন। এতেও ভালো ফল পাবেন।
চুলকে সিল্কি ও মসৃণ করে তুলতে পারবেন যেসকল উপাদানে:
উপকরণ –
- জবা ফুল
- মেথি
- লেবু
পদ্ধতি –
১. প্রথমে মেথি পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। তা নরম হয়ে গেলে বেটে তার থেকে রস বের করে নিন।
২. এরপর জবা ফুল থেকে এর রস আলাদা করে তার সাথে চুলের পরিমাণ বুঝে তাতে ১-২ চা চামচ লেবুর রস এবং পরিমাণ মতো মেথির রস মিশিয়ে চুলে লাগিয়ে নিন।
৩. চুল শুকিয়ে গেলে আপনার ব্যবহার করা শ্যাম্পু দিয়ে চুলকে ভালো ভাবে ধুয়ে ফেলুন।
মেথি এবং জবা ফুল চুলকে সিল্কি এবং মসৃণ করতে সাহায্য করে। চুলের বিভিন্ন প্রসাধনীতেও জবা ফুলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
চুলের খুসকির সমস্যা দুর করার সহজ উপায়
চুল নিয়ে আমাদের নানা সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমস্যা হল খুসকি। মাথায় খুসকি হলে চিন্তার শেষ থাকে না। পুরোনো কোষগুলো যখন ঠিকমতো ঝরে যেতে পারে না তখন সেগুলো জমে যায় এবং ফাঙ্গাস সংক্রমিত হয়। যার ফলে খুসকি হয়। মাথায় নানা ভাবেই সমস্যা হতে পারে। মাথার ত্বক যদি অতিরিক্ত তৈলাক্ত হয়,যদি চুল নিয়মিত পরিষ্কার না করা হয় তাহলেও সহজেই খুসকি হয়। চুল অনেক দিন পরিষ্কার না করলে চুলের চামড়া মরে যায়। ফলে খুসকির সৃষ্টি হয়। তবে এই সমস্যাও দূর করা যায় খুব সহজে। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক-
উপকরণ –
• তেঁতুল
• পানি
পদ্ধতি-
১. প্রথমে পুরোনো তেঁতুল পানিতে গুলে নিন।
২. এরপর তা আলতো ভাবে চুলের গোড়ায় লাগিয়ে নিন।
৩.১০-১২মিনিট অপেক্ষা করুন। তারপর আপনার ব্যবহার করা শ্যাম্পু দিয়ে চুলকে ভালো ভাবে পরিষ্কার করে নিন। এভাবে সপ্তাহে ২দিন চুলে লাগালে খুসকি দূর হবে। এমনকি মাথার চুলকানিও কমে যাবে।
উপকরণ-
• টক দই
• মেহেদি পাতা
পদ্ধতি-
১. প্রথমে মেহেদি পাতা বেটে তাতে ২টেবিল চামচ টক দই মিশিয়ে নিন।
২. এরপর তা আলতো করে চুলের গোড়ায় লাগান।
৩. চুল শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। শুকিয়ে গেলে শ্যাম্পু করে নিন। এভাবে সপ্তাহে একদিন করে ব্যবহার করলে চুলের খুসকি দূর করার সাথে সাথে চুল হয়ে উঠবে রেশমি।
উপকরণ-
• লেবুর রস
• পেঁয়াজের রস
পদ্ধতি-
১. প্রথমে ২চা চামচ লেবুর রসের সাথে ২চা চামচ পেঁয়াজের রস মিশিয়ে তাতে ১টা অথবা ২টা ডিমের সাদা অংশ মিশিয়ে নিন।
২. এরপর ভালোভাবে চুলের গোড়ায় লাগিয়ে নিন।
৩. চুল শুকিয়ে গেলে শ্যাম্পু করে ধুয়ে নিন। এতে করে চুলের খুসকি দূর তো হবেই। সাথে চুল হবে মসৃণ ও আকর্ষনীয়।
উপকরণ-
•মেথি
•লেবুর রস
পদ্ধতি-
১. প্রথমে মেথি ভিজিয়ে তা বেটে তার থেকে রস বের করে নিন। তার সাথে ২চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে নিন। এরপর মিশ্রণটি চুলের গোড়ায় লাগান।
২. এরপর চুল শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন। লেবু চুলের মরা চামড়া থেকে নিষ্কৃতি পেতে সাহায্য করে এমনকি চুলের তৈলাক্ততা দূর করতেও কার্যকরি।
চুলের আগা ফাটা রোধ করার ঘরোয়া কিছু উপায়
চুলের অনেক ধরনের সমস্যার মধ্যে আগা ফাটা অন্যতম। আগা ফাটার জন্য চুল বেড়ে ওঠে না। এমনকি চুল দেখতেও খারাপ দেখা যায়। তখন চুলের জন্য নিজেকে দেখতেও অনেকটা খারাপ লাগে বলে মনে হয়। কোনো অনুষ্ঠানের জন্য নিজেকে পারফেক্ট মনে হয় না। আর এই সমস্যা দূর করতে কতই না শ্যাম্পু, নামী দামি প্রসাধনী ব্যবহার করে অনেকে। অনেক সময়ই দেখা যায় তাতে কোনো কাজই হয় না। এমনকি ক্রয়কৃত প্রসাধণীর নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকে অনেক সময়। এতে চুলের অবস্থা আরও অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়। তাই আপনাদের চুল নিয়ে এই দুঃশ্চিন্তা দূর করতে আপনাদের জন্য রইলো কিছু ঘরোয়া উপায়। চলুন দেখে নেওয়া যাক-
চুলের আগা কাটা অংশ বাদ দিন : চুলের যতটুকু অংশ ফেটে গেছে তা সামান্য কেটে ফেলে দিন। তারপর এর প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান সরবরাহ করতে থাকুন, দেখবেন আপনার চুলের ঘনত্ব তো বাড়বেই সাথে সাথে চুল লম্বা হতেও শুরু করবে। চলুন, জেনে নেওয়া যাক কী কী উপায়ে আগা ফাটা রোধ করে চুলের পুষ্টির যোগান দিতে পারবেন।
উপকরণ-
- ডিম
- মধু
- অলিভ অয়েল
পদ্ধতি-
- প্রথমে একটি ডিমের সাদা অংশ আলাদা করে নিন।
- এরপর ১চা চামচ মধু,২চা চামচ অলিভ অয়েলের সাথে ডিমের সাদা অংশ মিশিয়ে নিন।
- তারপর চুলে আলতো করে লাগিয়ে শুকানোর জন্য অপেক্ষা করুন। শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা পানি দিয়ে শ্যাম্পু করে নিন। মাস খানেক ব্যবহার করলেই ফলাফল নিজের চোখেই দেখতে পাবেন। ডিমের সাদা অংশ চুলের জন্য উপকারী। তাই চুলে ডিম ও মধু ব্যবহার করলে উপকার পাবেন।
উপকরণ-
- জবা ফুল
- নারিকেল তেল
পদ্ধতি-
- একটা পাত্রে নারিকেল তেল নিয়ে তাতে ২-৩টা জবা ফুল দিয়ে কিছুটা গরম করুন।
- তারপর তা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিন।
- এরপর চুলে লাগিয়ে নিন। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন। চুল স্বাভাবিক অবস্থায় না ফেরা পর্যন্ত এই প্যাকটি ব্যবহার করুন।
উপকরণ-
- পাকা কলা
- টক দই
- গোলাপ জল
পদ্ধতি-
- ১টি পাকা কলা, ২চা চামচ টক দই, ১চা চামচ গোলাপ জল একসাথে মিশিয়ে চুলে লাগিয়ে নিন।
- শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে একবার করে ব্যবহার করুন। কলাতে থাকা পটাশিয়াম, জিঙ্ক, আয়রন, ভিটামিন ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান চুলের জন্য উপকারী, যা চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং আগা ফাটা রোধ করে।
চুল পড়া বন্ধ করতে কী করবেন?
আপনার যদি অনবরত চুল পড়তে থাকে তাহলে অবশ্যই তা রোধ করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। চুল পড়া বন্ধ করতে হলে এক্ষেত্রে সবার আগে আপনাকে জানতে হবে কী কারণে চুল পড়ছে। সবার ক্ষেত্রে যে একই কারণ তা নয়। ক্রমাগত চুল পড়া বন্ধ করার জন্য নিচের নির্দেশনাগুলি প্রাথমিকভাবে মেনে চলুন। আশা করি আপনি সুফল পাবেন।
১. খাদ্যাভাস বদলে নিন
আপনি যে ধরনের খাবার খান তা চুল পড়া বা নতুন চুল গজানোর উপর প্রভাব ফেলে। কম চর্বি এবং বেশি ফাইবার যুক্ত খাবার গ্রহণ করুন। এতে নতুন চুল গজাবে এবং চুল পড়া বন্ধ হবে।
চুল পড়া বন্ধ করতে চাইলে কিছু কিছু খাবার না খাওয়া ভালো। যেমন খুব কম ক্যালরি যুক্ত খাবার, ডিমের সাদা অংশ ইত্যাদি।
২. প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পান করুন
চুল পড়া বন্ধ করতে চাইলে আপনার শরীরের জন্যে যতটুকু দরকার সে পরিমাণ পানি পান করুন। শরীরে পানি্র পরিমাণ ঠিক থাকলে চুলের বৃদ্ধিও তাড়াতাড়ি ঘটে। পানি কম পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্য, খুশকি, ত্বক ফেটে যাওয়া, চুল পড়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এই কারণেই ডাক্তাররা প্রতিদিন কমপক্ষে আট গ্লাস পানি পান করার পরামর্শ দেন।
৩. চুলের সম্পূরক পুষ্টি বা হেয়ার সাপ্লিমেন্ট
কিছু হেয়ার সাপ্লিমেন্ট চুল পড়া বন্ধ করা ও প্রাকৃতিকভাবে চুল গজানোর ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরি। বাজারে প্রচুর হেয়ার সাপ্লিমেন্ট পাওয়া গেলেও তার প্রায় বেশিরভাগই তেমন কার্যকরি না। তাই বুঝে শুনে যাচাই-বাচাই করে হেয়ার সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করতে পারেন।
৪. চুলের যত্ন নিন
ঘন ঘন তাপ দিয়ে চুল শুকাবেন না। তাপ চুলের প্রোটিন, স্নিগ্ধতা ও উজ্জ্বলতা নষ্ট করে। তাই প্রাকৃতিকভাবে চুল শুকান। এতে আপনার চুল দৃঢ় ও মজবুত হবে। হেয়ার ড্রায়ার, হট ব্রাশ থেকে দূরে থাকুন।
যতটা সম্ভব চুল রঙ করা থেকে বিরত থাকুন। চুলে রাসায়নিক রঙ ব্যবহারের ফলে চুল পেকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
৫. চুল অত শক্ত করে বাঁধবেন না
অনেক সময় চুল রাবার ব্যান্ড বা ক্লিপ দিয়ে খুব শক্ত করে বাঁধতে হয়। নিয়মিত এ কাজ করলে সেটাকে চুল পড়ার একটি কারণ হিসেবে ধরা যায়। শক্ত বেণির কারণে চুলে টান পড়ে, যে কারণে চুলের গোড়া নরম হয়ে যায়।
৬. পর্যাপ্ত ঘুম
চুল পড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে অপর্যাপ্ত ঘুম। প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ ঘণ্টা ঘুমানোর অভ্যাস করুন।
চুলের যত্নে যা যা খেয়াল রাখবেন
নিয়মিত চুল আচড়ান। পুষ্টিকর খাবার খান। চুলকে পরিষ্কার রাখুন সবসময়। কারণ অপরিষ্কার চুলে খুসকি হয় বেশি। যদি দেখতে পান, উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করেও কোনো ফলাফল পাচ্ছেন না। তাহলে ভালো কোনো চর্মরোগের ডাক্তার দেখান।
শেষকথা
চুলের উচ্ছ্বলতা ছাড়া রুপসজ্জার সব অনুষঙ্গই যেনো ফিকে থেকে যায়। তাই প্রাণবন্ত, রেশমি, উজ্জ্বল চুলের কোনো বিকল্পই হতে পারে না। সুতরাং, চুলের যত্নে কোনোভাবেই অবহেলা করা চলবে না। আশা করি, এই লেখাটি ঘরোয়া উপায়ে চুলের যত্নে আপনাদের কাজে আসবে। নিজের প্রতি যত্নবান হোন। সুস্থ থাকুন।
সর্বশেষ হালনাগাদঃ ০৭/০১/২০২১