লবঙ্গ-এর উপকারিতা

দক্ষিণ এশিয়ার মহাদেশগুলোতে লবঙ্গ মসলা হিসেবে বেশ পরিচিত থাকলেও লবঙ্গের উপকারিতা সম্পর্কে অনেকেই অবগত নয়। যদিও অতি পরিচিত একটি মসলা তবে এর স্বাস্থ্যগত গুণাগুণের দিক দিয়ে অন্য মসলাগুলো থেকে এগিয়ে। পূর্বে যদিও এশিয়া মহাদেশে এর অস্তিত্ব ছিল না কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরেই বর্তমানে তা বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবকুটু দেশেই পাওয়া যায়। তাঁরা মূলত শরীর ভালো রাখতে লবঙ্গের ব্যবহার শুরু করে। এর উৎপাদন পূর্ব থেকে বেশ অনেকগুণ বেড়েছে। এর রয়েছে স্বাস্থ্যগত বেশ কিছু কার্যকর গুণ। লবঙ্গে রয়েছে ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, কার্বোহাইড্রেট, পরিমাণ মতো সুগার, ক্যালরি, ডায়েটারিফাইবার ইত্যাদি। এছাড়া লবঙ্গের তেলে আছে আরো উপকারি উপাদানসমূহ। অ্যাসিটাইল ইউজেনল, মিথাইল স্যালিসাইলেট সহ ইত্যাদি উপকারী উপাদান। লবঙ্গের মধ্যে উপকারি খনিজ পদার্থের মধ্যে আছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক  ইত্যাদি খনিজ উপাদান। লবঙ্গে উপস্থিত এসব খনিজ উপাদানগুলো দৈহিক স্বাস্থ্য রক্ষার্থে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ অঞ্চলে লবঙ্গ সবচেয়ে বেশি পরিচিত লং নামে। তাদের ভাষ্যমতে এটি লবঙ্গ বা লং। লং খাওয়ার মাধ্যমে হোক সেটা তরকারি কিংবা ঔষধ হিসেবে, উপকারিতা পেতে পারি। বর্তমানে এশীয়ার সমস্ত দেশগুলোতেই লং গাছ এর চাষ করে।

লবঙ্গের বহুমুখী উপকারিতা

অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, লবঙ্গ কি? বা কাকে বলে? মূলত লবঙ্গ হলো লবঙ্গ গাছের কুঁড়ি। যা আমাদের সবার নিকট লবঙ্গ নামে পরিচিত। জেনে রাখা ভালো যে, লবঙ্গ শুধুমাত্র যে মসলা হিসেবে ব্যবহার হয় তা কিন্তু নয়, বর্তমানে লবঙ্গ হারবাল ঔষধ হিসেবেও ব্যবহার হয়। সার্বিকভাবে লবঙ্গ বেশ উপকারি বিধায়, এটির ব্যবহার সর্বত্র। আলোচনা দীর্ঘায়িত না করে চলুন জানা যাক লবঙ্গের উপকারিতাগুলো-

  • লবঙ্গ চা দাঁতের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে
  • বমি বমি ভাব দূর করে
  • সর্দি-কাশি ভালো করে
  • ঠান্ডা লাগা কমায়
  • মাথা ব্যথা-যন্ত্রনা কমায়
  • পেঁটের অসুখ দূর করে
  • সাইনাসের ইনফেকসন হ্রাস করে
  • ব্রণের চিকিৎসায় লবঙ্গ
  • লবঙ্গ রক্ত পরিশোধন করে
  • খাবারের প্রতি রুচি বৃদ্ধি করে
  • খাদ্য হজমে সহায়তা করে
  • ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে লবঙ্গ
  • মুখের বিশ্রী গন্ধ দূর করে

দাঁতের ব্যথা কমায়

লবঙ্গে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি জাতীয় উপাদান। অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদানের মূলত প্রধান কাজই হচ্ছে দাঁতের প্রচন্ড ব্যথা দূর করা। এছাড়াও যাদের দাঁতের মাড়ির ক্ষয় হওয়ার রোগ রয়েছে, তাদের জন্য লবঙ্গ বেশ ‍উপকারক একটি উপাদান। দাঁতের ব্যথা, মাড়ি ক্ষয়, অত্যধিক যন্ত্রণাসহ দাঁতের যত্নে লবঙ্গ বেশ উপকারি। বর্তমানে প্রচলিত প্রায় সকল টুথপেস্টে লবঙ্গের উপাদান ব্যবহার করা হয়। যাতে দাঁত ক্ষয় রোধ হয় এবং দাঁতের ব্যথা হ্রাস পায়।

বমি বমি ভাব দূর করে

আমাদের মধ্যে অনেকে আছে, যারা গাড়িতে সময় যেমন- বাস কিংবা মাইক্রো সহ সকল প্রকার ইঞ্জিলে চালিত যানবানে চড়ার সময় নানান সমস্যার মুখামুখি হতে হয়। এর মধ্যে একটি হলো বমি বমি ভাব অনুভব করা। এই সমস্যাটি যদিও সবার ক্ষেত্রে ঘটে না তবে সংখ্যালঘিষ্ঠদের জন্য এটা বেশ কমন একটি সমস্যা। এরকম পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে লবঙ্গ বেশ ভালোভাবে উপকার করতে পারে। যখন গাড়ি-যানবাহনে চড়বেন, তখন মুখে একটি বা দুইটি অথবা একাধিক লবঙ্গ মুখে রেখে দিবেন। তখণ আর বমি বমি ভাব তৈরি হবে না। এছাড়াও সর্বক্ষেত্রে লবঙ্গের ব্যবহার রয়েছে। একজন প্রেগনেট মহিলার জন্য বমি বমি ভাব হওয়া কমন একটি ব্যাপার। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও লবঙ্গ সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে তাদের ক্ষেত্রে সকালবেলা বেশি বমি বমি ভাব তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে সকালবেলা একটি বা একাধিক লবঙ্গ মুখে দিলে বমি বমি ভাব দূর হয়। লবঙ্গের মধ্যে থাকা বিশেষ সুগ্ধ বমি বমি ভাব দূর করে।

সর্দি-কাঁশি ভালো করে

লবঙ্গ যে শুধু মাত্র সর্দি বা কাঁশির জন্য ফলসরূপ, তা কিন্তু নয়। পাশাপাশি কফ ঠান্ডা লাগা, অ্যাজমা সহ গলাফুলে উঠা ও শ্বাস কষ্টের ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যায়। তবে বিশেষ করে সর্দি – কাঁশির জন্য লবঙ্গ যেন এক মহা-ঔষধ এর নাম। এই ক্ষেত্রে রোগীকে লবঙ্গকে ভালোভাবে চিবিয়ে খেতে হবে। অথবা অন্যথায় লবঙ্গকে মুখে নিয়ে চুষে এর রস খেতে হবে। এভাবে কয়েকদিন একটানা খেলে শরীর থেকে সর্দি-কাঁশি দূর হবার পাশাপাশি উপরোক্ত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

ঠান্ডা লাগা কমায়

এটা যদিও প্রায় সর্দি কাঁশি ভালো করার মতোই। অর্থাৎ কারো যদি বুকে দীর্ঘদিন ঠান্ডা লেগে কফ কিংবা অ্যাজমার সমস্যা তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে সে কিছুটা হলেও উপকার পেতে পারে লবঙ্গ থেকে। কয়েকটা লবঙ্গ মুখে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ চিবিয়ে খেতে হবে। এতে করে শরীরের অভ্যন্তরীণ নানা ‍উপকার পাওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন হয়ে থাকা ঠান্ডা কমে যাবে।

মাথার ব্যথা কমায়

অনেকের মধ্যে এই সমস্যাটি অর্থাৎ তীব্র মাথা-ব্যথার সমস্যাটি লক্ষ্যণীয়। অতিরিক্ত ধোঁয়া কিংবা শ্লেষ্মার অথবা অত্যধিকে তাপপ্রবাহ রোদ্রে থাকার কারণে মাথা ব্যথা তৈরি হয়। এরকম বিশ্রী পরিস্থিতি থেকে বাচঁতে লবঙ্গ উপকার করতে পারে। লবঙ্গ চিবিয়ে খাওয়ার মাধ্যমে মাথা ব্যথা দূর করা যায়।

পেঁটের অসুখ দূর হয়

দেহে বিশেষ কিছু এনজাইমের ঘাঁটতির কারণে নানা সময় আমাদের পাকস্থলিতে বদ হজম হয়ে থাকে। এরকম বাজে পরিস্থিতি থেকে লবঙ্গ আমাদের কিছুটা সহায়তা করতে পারে। কিভাবে? যখন আমরা কয়েকটা লবঙ্গ চিবিয়ে খাবো তখন আমাদের পাকস্থলিতে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার এনজাইম তৈরি হবে এবং একই সাথে পেটের অতিরিক্ত গ্যাস, পেট ব্যথা, বদ হজম, কলেরা, ডায়েরিয়া সহ নানা রোগ দূর হয়ে যায়। তাই পেঁটের অসুখ ভালো রাখতে অন্তত দৈনিক একটি করে হলেও লবঙ্গ খেতে হবে।

সাইনাসের ইনফেকসন হ্রাস করে

ইগুয়েনাল নামক একটি বিশেষ পদার্থ রয়েছে যার প্রধান কাজ হচ্ছে সাইনাসের ইনফেকসন হ্রাস করানো। জেনে অবাক হবেন যে ইগুয়েনাল নাম এই পদার্থটি লবঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং যেসব ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে সাইনোসাইটিস রোগে আক্রান্ত এবং সাইনাসের ইনফেকসনের মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করছেন, তাদের জন্য লবঙ্গ হলো একটি বেশ উপকারক ক্ষেত্র বা মষলা।

ব্রণ দূর করে

প্রায় প্রাচীনকাল হতেই ব্রণের চিকিৎসায় লবঙ্গ ব্যবহৃত হয়ে আসছে ব্যাপক ভাবে। যেসকল ব্যক্তি প্রতিদিন ১ টি বা এর একাধিক লবঙ্গ খায়, তাদের অন্যদের তুলনায় তুলনামূলকভাবে ব্রণ কম হয়। লবঙ্গ বেঁটে পেস্ট করে মুখে অথবা ব্রণের উপর মেখে দিলে ব্রণের দাগ দূর হয় পাশাপাশি ব্রণও দূর হয়। এছাড়া লবঙ্গ খেলেও ব্রণ দূর হয়। মূলত ব্রণ দূর করতে লবঙ্গ বেশ উপকারক একটি মষলা।

লবঙ্গ রক্ত পরিশোধন করে

আমাদের শরীরের রক্তে অনেক প্রকার ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ আছে। দেহের রক্তকে শোধিত করার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে অনেক রকম ঔষধ খাওয়ার দরকার পড়ে। কিন্তু আমরা যদি নিয়মিত সকালে লবঙ্গ খাই তাহলে লবঙ্গে থাকা বিশেষ উপাদান রক্তকে পরিশোধন করে রক্ত পরিষ্কার করে ফেলে পাশাপাশি মানব শরীরকে সুস্থ্য রাখে।

খাবারের প্রতি রুচি বৃদ্ধি করে

যেকোনো কোনো ধরনের অসুখ বা অসুস্থতার শেষে সাধারণত আমাদের মুখে বা জিহ্বায় বেশিরভাগ সময়ে রুচি থাকে না। এমতোবস্থায় আমরা ডাক্তার কিংবা ফার্মেসির শরাপন্ন হই। এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে সামান্য একটি লবঙ্গ। প্রতিদিন সকারে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে কয়েকটি লবঙ্গ খেয়ে ফেলি এবং দুপুরে খাওয়ার পর আবার কয়েকটি লবঙ্গ খেয়ে নেই, তাহলে খুব দ্রুত আমাদের খাবার খাওয়ার রুচি ফিরে আসবে। রুচির এই সমস্যা বিশেষ করে জ্বর শেষে, পেট খারাপ, পেট হাঁপা ইত্যাদি রোগের পর দেখা দেয়।

খাদ্য হজমে সহায়তা করে

আমাদের শরীরের পাকস্থলিতে যখন এনজাইমের ঘাটতি তৈরি হয়, তখন পেটের নানা রকম পিড়ায় পড়তে হয় এবং একই সাথে আমাদের প্রচুর ভোগতে হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ এনজাইম পাকস্থলিতে তৈরি হলে সঠিকভাবে খাদ্য হজম হয়। আবার একই সাথে পেঁটের বিভিন্ন রকম বদ হজম থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আর এর থেকে বাঁচতে লবঙ্গ আমাদেরকে বেশ ভালোভাবে উপকার করতে পারে। লবঙ্গ পাকস্থলিতে গিয়ে খাদ্য হজমে সহায়তাকারী এনজাইম তৈরি করে এবং খাদ্য হজমে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণ করে

শর্করা এবং ইনসুলিনের মাত্রা যখন অনিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন আমাদের শরীরে ডায়াবেটিস রোগ বাসা বাঁধে। ডায়াবেটিস রোগীদের কিছুটা স্বত্বি দিতে পারে লবঙ্গ। লবঙ্গ এর রস আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি হতে সাহায্য করে আবার একইভাবে দেহের অতিরিক্ত শর্করা বের করে দেয়। যখন আমাদের শরীরে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে, তখন ডায়াবেটিস হওয়ার বা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবণা ব্যাপক থাকে। আর যথেষ্ট ইনসুলিনের অভাবে ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে লঙ্গ বা লবঙ্গ বেশ উপকারক একটি মষলা।

মুখের দূর্গন্ধ দূর করে

শুধু মাত্র মুখের দূর্গন্ধই নয়, পাশাপাশি মাড়ির সমস্যা, দাঁতের ক্ষয় সহ মুখের নানা রোগের সমস্যার প্রতিকার হিসেবে লবঙ্গ খুবই ভালো কাজ করে। আমাদের মুখের মাড়ির সমস্যা যেমন- জিনজিবাইটিস, পেরিওডনটাইটিস সহ আরো অনেক  রোগ রয়েছে, যেগুলোর জন্য লবঙ্গ প্রাচীন কাল হতেই ব্যবহার হয়ে আসছে। এই ক্ষেত্রে বিশেষ করে লবঙ্গের মাথার অংশটুকু ব্যবহার করে থাকে।

যাদে মুখে বিশ্রী দূর্গন্ধ রয়েছে, তাঁরা প্রতি রাতে শোয়ার আগে মুখে ২-৫টি লবঙ্গ মুখে দিয়ে ঘুমাবেন। এতে করে ধীরে ধীরে মুখের দূর্গন্ধ দূর হবে। এছাড়াও যারা দাঁতের অন্য সমস্যায় ভুগছেন যেমন দাঁতের মাড়ি ক্ষয় সহ ব্যথা, তারাও সেই ক্ষেত্রে লবঙ্গ ব্যবহার করতে পারেন একই নিয়মে। এতে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন।

শেষ কথা

উপরোক্ত উপকারিতার পাশাপাশি আরো অনেকগুলো উপকার রয়েছে লবঙ্গের, যেগুলোর দ্ধারা বেশ ভালোভাবে সবাই উপকৃত হতে পারে। অনেক আগ থেকেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় লবঙ্গ বেশ বড় একটি জায়গা জুড়ে রয়েছে। সুতরাং উপরোক্ত উল্লেখিত ‍উপকারিতাগুলো পেতে, দেখানো নিয়মে নিয়মিত লবঙ্গ ব্যবহার করুণ এবং এর উপকার দ্ধারা উপকৃত হোন।

Leave a Comment