শিশুদের ডায়াবেটিসের ১০ লক্ষণ, ধরণ ও প্রতিকার

বিশ্বে প্রতিটা দেশেই ডায়াবেটিকস একটা সাধারণ রোগ। অনেকের ধারণা হতে পারে ডায়াবেটিকস শুধু বড়দের হয়। তাহলে আপনি অনেক বড় ভুল করবেন। আপনার অজান্তেই আপনার কোমলমতি শিশুরও ডায়াবেটিকস হতে পারে। শিশুদের ডায়াবেটিসের লক্ষণ জানা না থাকলে একসময় কঠিন বিপদে পড়তে পারেন। বেশিরভাগ শিশু শৈশবে টাইপ 1 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় তবে টাইপ 2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু এবং অল্প বয়স্কদের সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়তে শুরু করেছে। একটা রিপোর্ট বলছে, প্রতি বছর দশ হাজার শিশুর মধ্যে সতেরজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাই আপনার সন্তানকে ডায়াবেটিকসের মতো রোগ থেকে বাঁচাতে এর লক্ষণ, ধরণ ও প্রতিকার জানা অপরিহার্য। তবে চিন্তার কারণ নেই এই আর্টিকেলেই শিশুদের ডায়াবেটিকসের লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সূচিপত্র

শিশুদের ডায়াবেটিসের ধরণ

টাইপ ১ ডায়াবেটিস

পূর্বে কিশোর ডায়াবেটিস নামে পরিচিত টাইপ-১ ডায়াবেটিস শিশুদের অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন উৎপাদন করতে অক্ষম হলে ঘটে। ইনসুলিন হলো দেহে সঠিক পরিমাণে গ্লুকোজ সরবরাহ করার প্রোটিনধর্মী হরমোন। এই ইনসুলিন ছাড়া চিনি রক্ত ​​থেকে কোষে চলাচল করতে পারে না এবং উচ্চ রক্তে শর্করার মাত্রা দেখা দেয়।

শৈশবকাল থেকে প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত যে কোনও বয়সে টাইপ 1 ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে তবে টাইপ-১ নির্ণয়ের গড় বয়স ১৩ বছর। এছাড়া ২০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যেও আনুমানিক ৮৫ শতাংশ টাইপ-১ ধরা পড়ে। রক্তের শর্করার মাত্রাকে লক্ষ্য সীমার মধ্যে রাখতে সাহায্য করার জন্য চিকিৎসায় আজীবন ইনসুলিনের ব্যবহার এবং রক্তে শর্করার তদারকির পাশাপাশি ডায়েট এবং ব্যায়াম করা অপরিহার্য।  

টাইপ ২ ডায়াবেটিস 

অল্প বয়স্ক শিশুদের মধ্যে টাইপ 2 ডায়াবেটিস কম দেখা যায়, তবে ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ না করলে এটি হতে পারে। পর্যাপ্ত ইনসুলিন না থাকলে গ্লুকোজ রক্ত ​​প্রবাহে জমা  করে। বড় হওয়ার সাথে সাথে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় তবে শিশুদেরও হতে পারে। শৈশবকালে মেদ বাড়ার সাথে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের হার বাড়ে। একটা রিপোর্ট জানিয়েছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৭৫ শতাংশ এরও বেশি বাচ্চাদের বংশগত বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের  লাইফস্টাইল অনুসরণ করার কারণে হয়। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত  পিতামাতা বা ভাইবোনদের সাথে থাকার কারণে শিশুদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। টাইপ-২ ডায়াবেটিস  নিয়ন্ত্রণে ঔষুধের প্রয়োজন। তবে আপনি চাইলে কিছু অভ্যাসের মাধ্যমে ডায়াবেটিস আয়ত্বে আনতে পারবেন।

শিশুদের ডায়াবেটিসের লক্ষণ

১.পলিডিপ্সিয়া বা অতিরিক্ত তৃষ্ণাভাব

পলিডিপ্সিয়া বা অতিরিক্ত তৃষ্ণার কারণে শিশুদের ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস হতে পারে। এই ধরণের ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে, প্রচুর পরিমাণে পানি পানের  সত্ত্বেও শরীরে তরলের ভারসাম্যহীনতা অত্যধিক তৃষ্ণার সৃষ্টি করে।

২.পলিউরিয়া বা ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।

পলিউরিয়া প্রায়শই পলিডিপসিয়া অনুসরণ করে।  শরীরে যখন  গ্লুকোজ স্পাইক হয় তখন কিডনিকে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে অতিরিক্ত গ্লুকোজ অপসারণের জন্য সংকেত দেয়। পলিউরিয়ায় এই ফলস্বরূপ, অতিরিক্ত পানি পানের প্রয়োজন হয়।

৩.অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগে 

আপনি যদি  লক্ষ্য করেন আপনার শিশুটি সব সময় ক্ষুধার্ত থাকে এবং অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ ক্ষুধার্তভাব পূরণ করতে পারে না তাহলে অবশ্যই  চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন কারণ মাত্রারিক্ত ক্ষুধা  ডায়াবেটিসের লক্ষণ হতে পারে। কারণ ইনসুলিন ছাড়া শরীর শক্তির জন্য গ্লুকোজ ব্যবহার করতে অক্ষম হয়  এবং শক্তির এই অভাব ক্ষুধা বাড়িয়ে তোলে।

৪.অস্বাভাবিক ওজন কমে যায়

শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিস মেলিটাসের আরও একটি লক্ষণ অব্যক্ত ওজন হ্রাস। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর ওজন হ্রাস হয়।  ইনসুলিনের কম উৎপাদনের কারণে শক্তিতে  যখন গ্লুকোজ রূপান্তর সীমাবদ্ধ হয়, তখন শরীর শক্তির জন্য পেশী এবং সঞ্চিত ফ্যাট পোড়ানো  শুরু করে এবং তখনই আচমকা ওজন কমে যায়।

৫.ফলের গন্ধের মতো শ্বাস-প্রশ্বাস

ডায়াবেটিক কেটোসিডোসিসের (ডি কেএ) কারণে ফলের গন্ধের মতো শ্বাস-প্রশ্বাস হয়। এরকম অবস্থা  শরীরে ইনসুলিনের অভাবে দেখা দেয় এবং এটি শিশুদের মধ্যে মারাত্মক ডায়াবেটিসের লক্ষণ হতে পারে। গ্লুকোজের অভাবে শরীর শক্তির জন্য ফ্যাট পোড়া শুরু করে এবং প্রক্রিয়াটি কেটোনস (রক্ত অ্যাসিড) তৈরি করে। কেটোনেসের সাধারণ গন্ধ শ্বাসকষ্টে ফলের মতো গন্ধ ছড়ায়।

৬.আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়

একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিক শিশুদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা ডায়াবেটিসবিহীন শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি। ডায়াবেটিস ৮০শিশুর  মধ্যে ২০জন  ডায়েটে অনিয়ম, রাগী স্বভাব, অন্তর্মুখী ও শৃঙ্খলা এবং শাসন প্রতিরোধ করার মতো খারাপ আচরণ দেখায়। এটি রোগ সহনশীলতা, বাড়িতে কঠোর রেজিমেন্টেশন, বাবা-মায়ের দ্বারা ভাইবোনদের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ বা অন্যদের মধ্যে ‘আলাদা হওয়ার’ অনুভূতির মতো বিভিন্ন কারণে  হতে পারে। এইসব কারণগুলো  মেজাজ পরিবর্তন, উদ্বেগ এবং হতাশার দিকে ঠেলে দিতে পারে। 

৭.ত্বক গাড় ও অন্ধকার হয়

অ্যাকানথোসিস নিগ্রিকানস (এএন) বা ত্বকের অন্ধকার সাধারণত ডায়াবেটিসের সাথে যুক্ত থাকে। শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এএন-এর সাধারণ সাইট হলো পেছন দিকের ঘাড়।  ইনসুলিন প্রতিরোধের ফলে সৃষ্ট হাইপারিনসুলিনেমিয়ার কারণে ত্বকের ভাঁজগুলো অন্ধকার এবং ঘন হয়। ত্বকের ভাঁজগুলো অন্ধকার এবং ঘন হয় ইনসুলিন প্রতিরোধের ফলে সৃষ্ট হাইপারিনসুলিনেমিয়ার কারণে।

৮.দৃষ্টি সমস্যা ধরা পড়ে

ডায়াবেটিস শিশুদের মধ্যে অকুলার রোগের প্রকোপ সাধারণ রোগের তুলনায় বেশি। ডায়াবেটিস নির্ণয়ের পরে নিয়ন্ত্রণ না করা হলে উচ্চ ব্লাড সুগার চোখের স্নায়ুর ক্ষতি করে এবং চোখের সমস্যা যেমন ঝাপসা দৃষ্টি বা সম্পূর্ণ অন্ধত্ব বয়ে আনে। শিশুদের মধ্যে এই ডায়াবেটিসের লক্ষণটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়।

৯.সবসময় ক্লান্তিভাব আসে

ক্লান্তি বা সবসময় ক্লান্তির অনুভূতি ডায়াবেটিস শিশুদের মধ্যে সহজেই লক্ষ্য করা যায়। টাইপ-১ ডায়াবেটিস শিশুর গ্লুকোজকে শক্তিতে রূপান্তর করার জন্য  পর্যাপ্ত ইনসুলিন থাকে না। এইরকম শক্তির অভাব  শিশুদের সামান্য  শারীরিক ক্রিয়াকলাপের পরে সহজেই  ক্লান্ত করে তোলে।

একটি সমীক্ষায় দেখা যায় টাইপ 1 ডায়াবেটিস মেলিটাসের শিশুদের মধ্যে ছত্রাকের সংক্রমণ বেশি হয়, বিশেষত মেয়েরা  এই অবস্থায় বেশি ভুগে।  অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা ডায়াবেটিসের মতো অটোইমিউন রোগ সংঘটন প্রতিরোধ করে। যখন উচ্চ শরীরে গ্লুকোজ মাইক্রোবায়োটাকে বাধা দেয় তখন অণুজীবের বৃদ্ধি প্রভাবিত হয়, যার ফলে তাদের বৃদ্ধি বেড়ে যায় যা ছত্রাক সংক্রমণে  বেশ অবদান রাখে।

১০.দেরিতে  ক্ষত নিরাময় হয়

দেহে উচ্চ রক্তে শর্করা প্রতিরোধ ক্ষমতা কার্যকারিতা ব্যাহত করে, প্রদাহ বৃদ্ধি করে, গ্লুকোজ রূপান্তরকে শক্তিতে আটকিয়ে রাখে এবং দেহের অংশগুলোতে রক্ত ​​সরবরাহ কমে যাওয়ার দিকে ঠেলে দেয়। এইসব কারণগুলো শিশুদের মধ্যে ক্ষত নিরাময়ে বিলম্বিত করে, যার ফলে আরও গুরুতর জটিলতায় পরিচালনা করে।

টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস যেভাবে প্রতিকার করবেনঃ

টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দেহে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি না হওয়ায় টাইপ-১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা কঠিন হলেও টাইপ ২ ডায়াবেটিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য।

নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ আপনার সন্তানের শৈশবে টাইপ 2 ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে:

১.পরিমিত ওজন বজায় রাখুন

অতিরিক্ত ওজন ইনসুলিন প্রতিরোধের সম্ভাবনা বাড়ার কারণে   টাইপ 2 ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। কারণ এটি ইনসুলিন প্রতিরোধের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।

২.সক্রিয় রাখুন

শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকলে  ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে এবং রক্তচাপ পরিচালনা করতে সহায়তা করে। তাই আপনার শিশুকে শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখতে স্পোর্টস বা ডান্স ক্লাবে ভর্তি করে দেন এবং সবসময় সক্রিয় রাখার চেষ্টা করুন।

৩.চিনিযুক্ত খাবার এবং অ্যালকোহল যুক্ত পানীয় সীমিত করুন

বেশি পরিমাণে চিনি খাওয়ার ফলে ওজন বাড়তে পারে এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতায় সমস্যা  হতে পারে। প্রচুর ভিটামিন, ফাইবার এবং চর্বিযুক্ত প্রোটিন সহ সুষম, পুষ্টিকর সমৃদ্ধ ডায়েট  টাইপ 2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমিয়ে  দেয়। 

৪.স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ান

আপনার শিশুকে কম ফ্যাট এবং ক্যালোরি যুক্ত খাবার খাওয়ান। ফলমূল,শাকসবজি এবং শস্যের প্রতি মনোনিবেশ করান এবং একগুয়েমি প্রতিরোধে বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে উৎসাহিত করুন। 

৫.ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন

ডায়াবেটিস কমাতে শিশুদের  মধ্যে ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।  শিশুদের ডায়াবেটিস কমাতে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। টাইপ ১  এর  টাইপ ২ ডায়াবেটিস বেশি ক্ষতি করে এবং টাইপ ১ শিশুদের মাঝে বেশি দেখা গেলেও টাইপ ২ও ইদানিং দেখা যায়। তবে পরিবারের সুদৃষ্টিই  পারেই শিশুদেরকে ডায়াবেটিসের প্রকোপ থেকে বাঁচাতে।

শেষকথা

পরিশেষে বলা যায়, বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও ডায়াবেটিস হতে পারে। বিশ্বে ডায়াবেটিকসের রোগী দিনকে দিনকে বেড়েই চলছে। ডায়াবেটিকস প্রতিরোধে সচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের ডায়াবেটিকস রোধে সচেতনার পাশাপাশি ক্যালরিযুক্ত খাবার কমিয়ে দিতে হবে। তাহলেই একটা সুস্থ, সুন্দর জাতি গঠন করা সম্ভব হবে।

শিশুদের ডায়াবেটিস সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর

১. কীভাবে শিশুর ডায়াবেটিস হয়?

শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসের সঠিক কারণ অজানা তবে পারিবারিক ইতিহাস, সংক্রমণের প্রথম দিকের এক্সপোজার এবং অটোইমিউন ডিসঅর্ডার বা প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে নিজের শরীরকেই আক্রমণ করা শিশুদের ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে।

২. ডায়াবেটিসের সাধারণ লক্ষণ কী কী? 

ডায়াবেটিসের সবচেয়ে সাধারণ তিনটি লক্ষণগুলো হলো পলিডিপসিয়া বা অতিরিক্ত তৃষ্ণা, পলিউরিয়া বা অতিরিক্ত প্রস্রাব এবং চরম ক্ষুধা।

৩. শিশুদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে? 

যদিও টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে শুরু করে যেসব বাচ্চারা বেশি ওজনের  বা স্থূলকায় ভোগে তাদেরকেও প্রভাবিত করতে পারে।

Leave a Comment