বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং এর ভবিষ্যৎ

ফ্রিল্যান্সিং নামক মুক্ত পেশাতে আসতে তরুণদের আগ্রহ অনেক। ফ্রিল্যান্সাররা ঘরে বসে বিদেশের নানা কাজ করে আয় করেন। কিন্তু অনেকে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এই মুক্ত পেশাতে আসতে পারে না। তাই এই পেশায় আসতে প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা।

ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ কি?

ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে অর্থ উপার্জন করার পেশাটি মূলত ফ্রিল্যান্সিং (Freelancing)। এখানে আপনি আপনার স্বাধীন মতো কাজ করতে পারবেন। ফ্রিল্যান্সিং (Freelancing) এর ক্ষেত্রে, আপনার এখন কাজ করতে ইচ্ছা না করলে আপনি না করলেও কোনো জবাবদিহিতার ব্যাপার থাকে না। নিজের ইচ্ছামতো সময়ে করতে পারবেন। এখানে আপনি বিভিন্ন বায়ারের সাথে কাজ করার সুযোগ পাবেন। এই পেশার নির্দিষ্ট কোনো অফিস নেই। আপনি যেকোনো স্থানে বসে কাজ করতে পারবেন। আপনার যদি দক্ষতা থাকে তাহলে অন্যান্য অনেক চাকরির থেকে বেশি বেতনে কাজ করতে পারবেন।

ফ্রিল্যান্সিং করতে কি কি দক্ষতা লাগে

ফ্রিল্যান্সিং অনেক বড় একটা বিষয়। নির্দিষ্ট করে কোনো দক্ষতাকে ফ্রিল্যান্সিং বোঝানো হয় না। এই পেশায় আসতে আপনাকে অবশ্যই নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের উপড় বিশেষ দক্ষ হতে হবে। যদি সব বিষয় জানার আগ্রহ থাকে তবে এই পেশায় সফলতা আনা সম্ভব নয়। তাই একটা বিষয়ের উপড় নিজেকে পুরোপুরি যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারলেই আপনি এই সেক্টরে নিজেকে সফল বলে দাবি করার সুযোগ পাবেন।

  • ডিজিটাল মার্কেটিংঃ ডিজিটাল মার্কেটিং এরও অনেক অংশ আছে। যার ভেতর রয়েছে ই-মেইল, ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুক ইত্যাদি সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে পণ্যের প্রচারণা করা। তাছাড়াও এসইও এর অনেক বড় একটা অংশ দখল করে রেখেছে। লিড জেনারেশনও এই কাজের অন্তর্ভুক্ত।
  • গ্রাফিক্স ডিজাইনঃ গ্রাফিক্স ডিজাইন ফ্রিল্যান্সিং অনেক বড় একটা জায়গা দখল করে রেখেছে। লোগো, বিজনেস কার্ড, টিশার্ট ডিজাইন বা এই ধরণের কাজ করতে পছন্দ করেন তারা এই সেক্টর নিয়ে কাজ করতে পারেন।
  • কন্টেন্ট রাইটিংঃ এখানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা ব্লগের জন্য বিভিন্ন বিষয়ের উপর আর্টিকেল লিখতে হবে। মূলত এখানে আপনাকে লেখালেখির কাজ নিয়েই আগাতে হবে।
  • ওয়েব ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্টঃ এই সেক্টরের জন্য প্রোগ্রামিং জ্ঞান থাকা জরুরি। কোডিং এর উপর দক্ষ হতে পারলে এই সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়া খুব সহজ।
  • সফটওয়্যার ডেভেলপারঃ এখানে প্রোগ্রামিং এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন সফটওয়্যার বা মোবাইল অ্যাপ তৈরি করার কাজটাই হল সফটওয়্যার ডেভেলপারদের কাজ।

এখানে কিছু জনপ্রিয় ফ্রিল্যান্সিং কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন আপনাকে নিজের ভাবতে হবে কোনটি আপনার জন্য উপযুক্ত হবে। তারপর সেই নির্দিষ্ট টপিকের উপর নিজেকে দিক্ষ করে তুলতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সার এর সংখ্যা কত?

প্রায় ৬ লাখ লোক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ফ্রিল্যান্সিং এর সঙ্গে জড়িত আছে। আইএলও’র প্রতিবেদনে প্রথমেই আছে ভারত, অর্থাৎ মোট অনলাইন লেবার সাপ্লাইয়ের প্রায় ৩৩ শতাংশ ভারতের, ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৬ শতাংশ। এরপর বাংলাদেশের অংশগ্রহণ আছে প্রায় ১৩ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ছিল ২০ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশের পরই অবস্থান পাকিস্তানের, তবে ব্যবধান খুবই সামান্য।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের অনলাইন লেবার ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ভারত লেবাররা ৫৮ শতাংশই সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং প্রযুক্তিগত কাজ করে অনলাইনে। সেখানে বাংলাদেশের মাত্র ১৫ শতাংশ কাজ করে এই সেক্টরে। অনলাইন লেবার ইনডেক্সে ভারতের অবস্থান প্রথম এবং বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।

সরকারের আইসিটি বিভাগ বলছে, দেশে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ, যারা অন্তত ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে। তবে এর মধ্যে ফুলটাইম ফ্রিল্যান্সার দেড়-দুই লাখ হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিএফডিএস)। এই ফুলটাইম ফ্রিল্যান্সারদের সঙ্গে যারা ছোট ছোট দলে কাজ করেন, তারাসহ মোট সাড়ে ৩ লাখের মতো ফ্রিল্যান্সার আছেন। ঝরে পড়া ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা মিলিয়ে ছয় লাখের মতো হতে পারে বলে ধারণা বিএফডিএস’র।

ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে বাংলাদেশের অবস্থান সারাবিশ্বে কততম?

গ্লোবাল গিগ ইন্ডেক্স ২০১৯-২০ সালের প্রতিবেদনে 27% বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং এ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। এমন উন্নতির পেছনে ফ্রিল্যান্সারদের নিজস্ব চাহিদার প্রভাব রয়েছে। তুলনামূলক কম সুবিধা পেয়েও বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২১ সালে করোনা ভাইরাসে অনেকে জব হারানর পর এই পেশাকে আপন করে নেয়। এর ফলে ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা বেড়ে যায়।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে বর্তমান অবস্থান অষ্টমে রয়েছে বাংলাদেশ। 2017-18 সালে ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ছিল সপ্তম স্থান। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশকে টপকে ভারত সপ্তম স্থান দখল করে।তবে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশের বায়াররা বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য সেরা দেশ মনে করেন। কাজের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার দিক থেকে  বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের অন্যান্য দেশের ফ্রিল্যান্সারদের তুলনায় খুব ভালো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা খুব দ্রুত গতিতে উন্নতি করেছে এবং ইনকামের দিক থেকেও অনেক অগ্রগতি হয়েছে।

বাংলাদেশে কোন ফ্রিল্যান্সিং দক্ষতার চাহিদা বেশি

নতুন ফ্রিল্যান্সিং করতে চাওয়া ব্যাক্তিদের মনে প্রশ্ন জাগে ফ্রিল্যান্সিং এ কোন কাজের চাহিদা বেশি। কোন কাজটি শিখলে আমি বেশি টাকা ইনকাম করা সম্ভব। ফ্রিল্যান্সিং এ কোন কাজের চাহিদা বেশি সেটা জানার জন্য ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস গুলো যাচাই করতে হবে। সেখানে যাচাই করে দেখতে হবে কোন কাজের চাহিদা বেশি। কোন কাজ গুলো সব থেকে বেশি পাবলিশ করা আছে। সেখান থেকে ধারণা করা যাবে ওয়েব ডিজাইন এর চাহিদা বেশি নাকি গ্রাফিক্স ডিজাইন এর চাহিদা বেশি। নাকি কনটেন্ট রাইটিং নাকি এসইও এর। এর জন্য আপনি যদি একটি মাত্র মার্কেটপ্লেস যাচাই করেন তাহলে ভুল করবেন, কারন এক এক মার্কেটপ্লেসে এক এক কাজের চাহিদা বেশি দেখা যায়। তাই অনলাইনে যতগুলো ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস রয়েছে সব গুলো যাচাই করা প্রয়োজন।

আর আপনি যদি জান্তেই চান ফ্রিল্যান্সিং এ কোন কাজের চাহিদা সব থেকে বেশি, তাহলে আমি বলবো সকল কাজের চাহিদা মোটামুটি সমান। ফ্রিল্যান্সিং কাজের চাহিদা নির্ভর করে আপনার দক্ষতার উপর। সকল কাজের চাহিদা রয়েছে, কিন্ত প্রয়োজন দক্ষতা অর্জন করার।

খেয়াল করে দেখুন, আপনাদের বাজারে সবাই কিন্তু একই দোকান দেয়নি। কেউ দিয়েছে মুদির, কেউ কাপড়ের, কেউ জুতার, কেউ দিয়েছে বইয়ের দোকান।

লক্ষ করলে দেখতে পাবেন সবাই কিন্ত ভালো ভাবে ব্যবসা করছে। আপনি যখন বাজারে যান তখন কি সব জিনিস একই দোকান থেকে কিনেন? নাকি এক এক জিনিস এক এক দোকান থেকে কিনেন? নিশ্চয়ই আপনি এক এক দোকান থেকে এক এক জিনিস কিনেন। মুদির দোকান থেকে চাল, ডাল, তেল। জুতার দোকান থেকে জুতা। বইয়ের দোকান থেকে বই কিনেন। ঠিক একই ক্ষেত্রে হয় মার্কেটপ্লেস গুলোতে।

ধরুন, আপনি একজন ক্লায়েন্ট বা বায়ার এবং আপনি একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে চাচ্ছেন। তাহলে আপনার একজন ওয়েব ডেভেলপার দরকার। কারণ যে যেন সুন্দর করে আপনার একটি ওয়েবসাইট বানিয়ে দিতে পারে। ওয়েবসাইট বানানোর পরে দরকার হবে সেখানে কনটেন্ট পাবলিশ করার।

তাই এবার কনটেন্ট রাইটার দরকার। সে যেন আপনার ওয়েবসাইটের জন্য কনটেন্ট প্রস্তুত করে দিতে পারে।পরবর্তীতে কনটেন্ট গুলো গুগল সার্চ ইঞ্জিনে টপ রেংকে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন হবে একজন এসইও এক্সপার্ট এর।এভাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ব্যাক্তিদের কাছে আপনাকে যেতে হবে। তাই শুধু একটা ক্যাটাগরি কাজের চাহিদা এমনটা কখনো ভাবা যাবে না।

তবে, এক এক ক্যাটাগরির কাজের পেমেন্ট  এক এক রকম হয়ে থাকে। একজন ওয়েব ডেভেলপারের পেমেন্ট আর একজন কনটেন্ট রাইটারের পেমেন্ট এক নয়।আবার একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনারের পেমেন্ট আর একজন এসইও এক্সপার্ট এর পেমেন্ট এক নয়। মজুরির বিষয়টা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আপনার দক্ষতার উপর।

দক্ষতা যে কোনো ক্যাটাগরির কাজের উপর হতে পারে। তবে যে নিজের শেখার আগ্রহের উপড় নির্ভর করে যে কোনো একটা ক্যাটাগরি এর উপড় নিজেকে আগে দক্ষ করে নিতে হবে।

পরিশেষে, মার্কেটপ্লেসের পাশাপাশি সবার উচিৎ কাজের বিশাল জগৎটাকে আবিস্কার করার চেষ্টা করা। ফ্রিল্যান্সিং এর ভবিষ্যৎ খুবই ভাল, তাই নিজেকে আপগ্রেড করে, সময়ের সাথে তাল মিলাতে হবে, আর তাহলেই ফ্রিল্যান্সিংএ ভাল করা, এবং দীর্ঘদিন টিকে থাকা অনেক সহজ হবে।

Leave a Comment