খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ থেকে ৩২২ যখন অ্যারিস্টটল তার Meteorologica-তে আনাক্সাগোরাস(Anaxagoras) আর ডেমোক্রিটাস (Democritus) নামে দুটি গ্রিক ফিলোসফার সম্পর্কে বলেন । তিনিই সর্বপ্রথম আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি গ্যালাক্সির খোঁজ করেন । এই দুই গ্রিক ফিলোসফার অনুসারে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দূরে অবস্থিত অসংখ্য তারার এক সমষ্টি । কিন্তু অ্যারিস্টটলের এই দাবির অনেক পরে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও গ্যালিলি গ্যালাক্সি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে সক্ষম হন । তিনি নিজের টেলিস্কোপ এর সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করেন । তিনি বলেন মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি একটি Sparial Dish বা থালার মতো দেখতে যেটি লক্ষ্য কোটি একক নক্ষত্র নিয়ে গঠিত । মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যে যে নক্ষত্রটি সবথেকে পুরানো অনুমান করা হয় তার বয়স ১৩.৭ গিগাইয়ার মানে কিছু এই রকম ১৩৭০০০০০০০০ কোটি । অনুমান করা হয় এই Galaxy Big Bang -এর দ্বারা গঠিত হয়েছিল । আর আমাদের সূর্য এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ছোট্ট একটি নক্ষত্র যাকে পরিক্রমণ করছে আমাদের পৃথিবী ।
আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো?
রাতের মেঘমুক্ত আকাশে তাকেলে সাদা মেঘের মত একটা অস্পষ্ট ঝাপসা দাগ দেখা যায় যা উত্তর থেকে দক্ষিন দিকে চলে গিয়েছে। এর নাম ছায়াপথ। আমরা এই ছায়াপথের ভেতরে বাস করি। এর ইংরেজি নাম Milkyway Galaxy এবং বাংলায় আকাশগঙ্গা ছায়াপথ বলা হয়। আমাদের সূর্য-গ্রহ-উপগ্রহ এই ছায়াপথের ভেতর অবস্থান করছে। কিন্তু আমাদের অবস্থান এবং দৃষ্টিশক্তির চেয়ে বিশাল হওয়ায় সম্পূর্ণ ছায়াপথটি আমরা দেখতে পাইনা। এটি দেখতে অনেকটা মশার কয়েলের মত।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ত্রিমাত্রিক ম্যাপ তৈরি করার জন্য ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা(ইসার) ২০১৪ সালে ৯ ই জানুয়ারি উৎক্ষেপণ করে ”গায়া” টেলিস্কোপসহ একটি রকেট। এটির অবস্থান করছে পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কি.মি। এই টেলিস্কোপটির সাথে সেট করে দেওয়া হয়েছে অত্যান্ত শক্তিশালী একটি ক্যামেরা। যার ক্ষমতা ১০০ কোটি পিক্সেল!
এই টেলিস্কোপটির তৈরি করার মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ত্রিমাত্রিক (3D) ম্যাপ তৈরি করা। এজন্য এই টেলিস্কোপটির নকশা করা হয় যেন খুব সহজে এটি মহাকাশে ছবি তুলতে পারে। একই সাথে এটি গ্রহ, ধুমকেতু, গ্রহাণুর একটি ত্রিমাত্রিক তালিকা তৈরি করবে। এছাড়াও এটি বৃহস্পতি আকৃতির ১০ হাজার বহিগ্রহ, ৫ লক্ষ কোয়াসার এবং সৌরজগতের ১০ হাজার গ্রহাণু শনাক্ত করতে সক্ষম হবে বলে প্রত্যাশা করেছেন ইসার মহাকাশ বিজ্ঞানীরা।
এই অভিজানটির প্রধান বিজ্ঞানী মার্ক ম্যাককফরেন বলেছেন, “এই অভিযানটি দিয়ে আমরা সহজেই গ্যালাক্সির রহস্য উদঘাটন করতে পারবো। এর মাধ্যমে ১০০ কোটি নক্ষত্রের অবস্থান নির্ভুলভাবে ম্যাপ আকারে তৈরি করা যাবে। শুধু তাই নয়,তারা কিভাবে ঘুরছে বা কি গতিতে ঘুরছে,তাও জানা যাবে। এর মধ্যে দিয়ে আমররা গ্যালাক্সির ডকুমেন্টরি তৈরি করে ফেলতে পারব। ভবিষ্যতে কি হবে তা জানার জন্য ত্রিমাত্রিক ম্যাপটিকে আমরা সামনের দিকে চালাতে পারব। যেহেতু এই তারাগুলো কিভাবে চলছে তা আমাদের জানা হয়ে যাবে। সুতরাং, এটাকে আমরা আবার পেছনে দিকেও চালাতে পারবো। ফলে দেখতে পারবো যে কিভাবে এই ছায়াপথের জন্ম হলো।”
তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ডকুমেন্টরি তৈরির মাধ্যমে যদি তারাদের ভবিষ্যৎ অবস্থান সনাক্ত করা যায়, তাহলে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে কীভাবে ছায়াপথের জন্ম হলো, তা জানার আমাদের পক্ষে খুবই সহজ হয়ে যাবে।
ইসার এই অভিযানের মাধ্যমে ১ বিলিয়ন নক্ষত্রের দিয়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির নিখুঁত ত্রিমাত্রিক ম্যাপ তৈরি করার কথা থাকলেও এ বছরের ২৫ শে এপ্রিল ইসার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল ১.৭ বিলিয়ন নক্ষত্রসহ একটি নিখুঁত ছবি। যা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিটির এখন পর্যন্ত তোলা সবচেয়ে নিখুঁত ছবি। এই ছবি সবাইকে বিস্ময় করে দেয়।
আমাদের পৃথিবী এবং আমরা এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যেই অবস্থান করছি । আপনাদের মনে হতে পারে যে বারবার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি কে কেন আমাদের গ্যালাক্সি বলা হচ্ছে । ১৯২০ সাল পর্যন্ত Astronomers-রা মনে করতেন যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি পুরো ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একটি গ্যালাক্সি যেখানে সমস্ত নক্ষত্র অবস্থান করছে । কিন্তু ১৯২০-র পর এডুইন হাবল (Edwin Hubble) 2.5 m (100 in) Hooker Telescope-এর সাহায্য নিয়ে বলেন যে এই পুরো ব্রহ্মাণ্ডে একটি গ্যালাক্সি নয় বরং লক্ষ-কোটি গ্যালাক্সির অস্তিত্ব আছে । আর এইসব গ্যালাক্সির মধ্যেই একটি হল আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি । অনুমান করা হয় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ডায়ামিটার প্রায় এক লক্ষ থেকে এক লক্ষ আশি হাজার লাইট ইয়ার । এই গ্যালাক্সি এতটাই বড় যেখানে রয়েছে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্রের অস্তিত্ব । এছাড়া ১০০ মিলিয়নের থেকে বেশি প্ল্যানেট মিল্কিওয়েতে থাকতে পারে ।
আমাদের সৌরমন্ডল এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির গ্যালাক্টিক সেন্টার থেকে ২৬০০০ লাইট ইয়ার দূরে অবস্থিত আর গ্যালাক্টিক সেন্টারের সাপেক্ষে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে প্রতি ঘন্টায় ৫ লাখ ১৪ হাজার মাইল স্পীডে ঘুরতে থাকে । এত দ্রুত স্পিডে পরিক্রমণ করার শর্তেও আমাদের সৌরমন্ডল মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে একবার ঘুরে আসতে ২৩০ মিলিয়ন বছর সময় নিয়ে নেয় । সংস্কৃততে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে আকাশগঙ্গা নাম দেওয়া হয়েছে যাকে আমরা ইংরেজিতে Ganges of The Heaven নামও জেনে থাকি । আমরা রাতের আকাশে খালি চোখে যত নক্ষত্র দেখতে পাই তাদের মধ্যে বেশিরভাগ নক্ষত্রই আমাদের এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্তর্গত । যার মাত্র ০.০০০০০২৫ শতাংশই আমরা দেখতে পাই । এইসব বড় বড় নক্ষত্রের সাথে গ্যাস, Dust এছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন পদার্থ মিলেমিশে একটি গ্রাভিটেশান পুলের দ্বারা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি তৈরি হয়েছে । পুরো ব্রহ্মাণ্ডে কয়েক লক্ষ কোটি গ্যালাক্সি অস্তিত্ব আছে যার মধ্যে মিল্কিওয়ে একটি গ্যালাক্সি ।
এই বিশাল গ্যালাক্সিতে যে নক্ষত্রগুলি পরিক্রমণ করছে তারা যদি এই গ্যালাক্সির বাইরে যেতে চায় তাহলে গ্যালাক্সিতে আগে থেকে ঘুরতে থাকা অব্জেক্ট গুলি যেগুলি প্রায় ৬ লক্ষ মাইল P/h গতিতে ঘুরছে তার থেকেও ১০ লক্ষ P/h গতিতে বেশি ঘুরতে হবে । বৈজ্ঞানিকরা আজ পর্যন্ত প্রায় ১৮ টি এমন নীল নক্ষত্রকে চিহ্নিত করেছেন যারা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে চলে গেছে কিন্তু বৈজ্ঞানিকেরা এটা জানতে পারিনি যে এইসব নক্ষত্রগুলি এত Energy কোথা থেকে এবং কিভাবে পেয়েছে । মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি নিজে ১৬৮ মাইল পার সেকেন্ডের গতিতে ঘুরছে । এটা থেকে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে এখন আপনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন মানে আমাদের পৃথিবী এক ঘণ্টা পরে সেই জায়গা থেকে ৬ লক্ষ মাইল দূরে চলে যাবেন ।
বৈজ্ঞানিকেরা মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমেডার মত ৫০ টি আরো এইরকম গ্যালাক্সিকে লোকাল গ্রুপের অংশ মনে করেন । এইসব গ্যালাক্সি একটি সাময়িক মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে একসাথে টিকে আছে । আমাদের সৌরমন্ডল সম্পূর্ণ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে পরিক্রমণ করছে প্রতি ঘন্টা প্রায় ৫ লক্ষ ১৪ হাজার মাইলস স্পিডে । এই স্পিডে যদি কোন অব্জেক্ট পৃথিবীতে একবার প্রদক্ষিণ করে তাহলে ওই অব্জেক্টের পৃথিবীরকে একবার ঘুরে আসতে মাত্র ২ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড সময় লাগবে । আর এই স্পিডেই আমাদের সৌরমন্ডল পুরো গ্যালাক্সিকে একবার প্রদক্ষিণ করতে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর লাগিয়ে দেয় । আর যখন আমাদের সৌরমণ্ডল একবার এই গ্যালাক্সিকে পরিক্রমণ করে তখন তাকে বলা হয় One Galactic Year । আমাদের সৌরমণ্ডল তার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২০ বার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে পরিক্রমণ করতে পেরেছে ।
বৈজ্ঞানিকদের মত অনুসারে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একদম কেন্দ্রে একটি শক্তিশালী মধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করছে যাকে ব্ল্যাকহোল বলা হয়ে থাকে । এই ব্ল্যাক হোল কে বৈজ্ঞানিকেরা Sagittarius A* নাম দিয়েছেন । বৈজ্ঞানিকেরা অনুমান করছেন যে আগামী ৪ বিলিয়ান বছরের মধ্যে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এবং প্রতিবেশী গ্যালাক্সি এন্ড্রোমিডার মধ্যে একটি ভয়ানক ধাক্কা লাগবে । যেটা প্রায় ৫.৫ বিলিয়ান বছর পর্যন্ত চলতে পারে । মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি সম্পর্কে আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া তথ্যগুলি খুবই সামান্য বলে মনে করা হয় কারণ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি সম্পর্কে আরও তথ্য পেতে এখনো অনেক বাকি আছে ।
তথ্যসূত্র:
https://en.wikipedia.org/wiki/Gaia_(spacecraft)
https://www.esa.int/Our_Activities/Space_Science/Gaia
https://www.space.com/41312-gaia-mission.html
http://sci.esa.int/gaia/